মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নার্সারি ব্যবসা শুরু করে, নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন মোশাররফ হোসেন। বেশি লেখাপড়া করতে না পারলেও অল্প বয়সে তিনি হাল ধরেছেন সংসারের। নার্সারী ব্যবসাতেই ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে তাঁর। এসএসসি পাসের পর তার আর পড়াশোনা করা হয়নি। বাবা-মা আর তিন ভাই-বোনের সংসারে টানাপোড়েন নিয়েই চলছিল জীবন। ফুলতলার গাড়াখোলা গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ ১৯৯৫ সালে প্রথম গাছ লাগানো শুরু করেন। মাত্র পাঁচ শতাংশ জমিতে নার্সারি শুরু করেন। নাম দেন মেসার্স জয়েন্ট নার্সারী। পরে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গোটা পরিবারের চেহারা বদলে গেছে এই নার্সরী ব্যবসার মাধ্যমে। তরুন উদ্যোক্তা মোশাররফ হোসেনের নার্সারী ব্যবসা খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। কঠোর ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বর্তমানে ২২ বিঘা জমিতে রয়েছে তার ছয়টি নার্সারী। নিজের বেকারত্বতা ঘোচানোর পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন।
ব্যবসা শুরুর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন মোশাররফ। পরবর্তীতে বাংলাদেশের নার্সারী ব্যবসায়ীদের ফুসফুস খ্যাত বেজেরডাঙ্গায় জমি বর্গা নিয়ে বড় পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তার ২২ বিঘা জমির উপর ছয়টি নার্সারী রয়েছে। রয়েছে ৭০ প্রজাতির উপর নানান জাতের ফলদ,বনজ,ঔষধি সহ হরেক রকমের দেশি-বিদেশি জাতের ফুল ও ফলের গাছ। বর্তমানে তার নার্সারীতে ৫০ হাজারের অধিক গাছ রয়েছে। নার্সারী দেখাশুনা করেন ১০-১২ জন কর্মচারি।
বেচাকেনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, প্রতিদিন ৩৫-৪০ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার গাছ বিক্রি করেন তিনি। বর্গা নেয়া জমির ভাড়া, কর্মচারিদের বেতনসহ নানান খরচ বাবদ মোটা অংকের টাকা ব্যয় হয় তাঁর। এরপরও বছরে মোট বিক্রির উপর ১০-১৫ শতাংস লাভ থাকে। তবে করোনার কারণে এ বছরের বেচা বিক্রি কম । নার্সারী ব্যবসার ভরা মৌসুমে ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। এ সময় গাড়ি বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসতে পারেননি। পরবর্তীতে গাড়ি ছাড়লেও ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ায় কেনাবেচা কমে যায়। প্রায় চার দশক পূর্বে ফুলতলার প্রাণকেন্দ্র বেজেরডাঙ্গায় গড়ে উঠা নার্সারি শিল্প এবার কিছুটা ধুকে ধুকে চলছে।
তিনি জানান, আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বপন করা বীজ থেকে এক লক্ষের অধিক বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশী ফুলের চারা প্রস্তুত হবে। সারাদেশ থেকে নার্সারী ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে এখান থেকে গাছ নিয়ে যায়। নার্সারীতে কি ধরনের গাছ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন , এখানে দেশি-বিদেশী সব জাতের গাছ রয়েছে। বিদেশী ফলের মধ্যে উন্নত জাতের শরুফা, আলুবোখারা, রামবুটান, ডরিয়ন, থাই সফেদা, স্ট্রবেরি পেয়ারা, ডেউয়া, বেরাকাটা পেয়ারা, ড্রাগন, মালেশিয়ান অ্যাবোকাটো, ফারসিমন, নাশপতি, অস্ট্রেলিয়ান আপেল, তীনফল গাছ, কিউই, স্ট্রবেরি, থাই ম্যাংগো স্টিন, চাইনিজ মাল্টা, পিউলিসহ বিভিন্ন জাতের গাছের চারা রয়েছে।
বিদেশি ফুলের মধ্যে রয়েছে আমেরিকান প্রাজাতির ইনকা, হানিকম, পিটুরিয়া, ডাইনথাস, কিসমাস ট্রি, থাই গোলাপ, ভিমকাসহ অসংখ্য প্রজাতির ফুল গাছ। এসব বিদেশি ফুল ও ফল চাষের অভিজ্ঞতা নিতে তিনি মালয়েশিয়া,থাইল্যান্ড ঘুরে বেড়িয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মসলা জাতীয় গাছের চারাসহ বিলুপ্তপ্রায় ঔষধি গাছের চারাও রয়েছে এখানে। বনজ চারার মধ্যে মেহগুনি, সেগুন, সিরিশসহ অন্যান্য, ওষুধি গাছের মধ্যে আমলকি, হরতকি, বয়রা, চালতে, লেবুসহ হরেক রকমের গাছ রয়েছে।
দেশি ফলের মধ্যে রয়েছে বারোমাসি কাঁঠালের কলম চারা। আমের জাতের মধ্যে হাঁড়িভাঙা, ল্যাঙড়া, আম্রুপালি, হিম সাগর, গুটি, ফজলি, গৌরমতি, কাঠিমণ, বারি-৪, বেনানা ম্যাঙ্গো সহ প্রায় ৩৫ প্রকারের চারা রয়েছে। সুপারির চারা রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার।নানান প্রজাতির নারকেলের চারা রয়েছে তিন হাজারের অধিক।
তিনি আরো জানান, চলতি মৌসুমে সুপারি, নারিকেল,পেয়ারা, আম ও মাল্টার চারা বেশি বিক্রি হচ্ছে। দেশি ফুলের মধ্যে রজনীগন্ধা, চায়না টগর, হাছনাহেনা, বকুল, কৃষ্ণচুড়া, বেলি, গন্ধরাজ,ডালিয়া,শিউলী,গোলাপ,রঙ্গন, জবা, রকমারি প্রজাতির পাতাবাহার, ঝাউ গাছসহ অসংখ্য প্রজাতির চারা রয়েছে।
ফুলতলা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা নাজমুস সাকিব জানান, বেজেরডাঙ্গার অন্যান্য নার্সারী মালিকদের থেকে মোশাররফ হোসেনের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা। আমরা তাঁকে প্রয়োজনীয় পরার্মশ দিয়ে সহযোগিতা করি। করোনাকালিন সময়ে আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
ফুলতলার বেজেরডাঙ্গার যশোর-খুলনা মহাসড়কের দু’পাশে সারি সারি ফুল, ফলের সমারহে গড়ে ওঠা অসংখ্য নার্সারী দেখলে বিমোহিত হবে যেকোন মানুষ। খুলনা শহর থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় অনেকেই নিজেদের ছাদবাগান বা বাড়ির আঙ্গিনা সাজাতে ছুটে যান সেখানে। সংগ্রহ করেন পছন্দের হরেক রকমের গাছ। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার মানুষ নার্সারি থেকে বাহারি ফুল, ফল ও মসলা জাতীয় গাছ কিনতে আসেন। বৃক্ষের প্রতি প্রেম ও স্বাবলম্বী হওয়ার তাগিদ মোশাররফ হোসেনকে একজন সফল নার্সারি ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার সফলতা দেখে অনেক বেকার যুবক নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন নার্সারি ব্যবসায়।
খুলনা গেজেট /এমকে/এমএম